আগুনে পোড়া ভালোবাসা

Date:

 

তখন ভরা বর্ষা। পানিতে থৈ থৈ করছে। তার মাঝখানে পদ্ম
ফুটেছে। পদ্ম ফুলে ফুলে ফড়িং উড়ছে। হালকা হাওয়া জল নড়ছে।
পুরোনো বাঁশবাগানটি ছাতার মতো ছায়া হয়ে আছে। তার মাঝখানে
মাছরাঙ্গা, ঘুঘু আর শালিকের দল। পুকুরটি উত্তর দিকটায় আমগাছের
তকতা বিছিয়ে কাপড় কাচছেন ফাহমিদা খালা। ধাপাস্ ধাপাস্ শব্দে
পুকুরের জলে মৃদু টেউ তুলছে। বয়সের ভারে যেমনটী হয়। ফাহমিদা
খালার একমাত্র মেয়ে আদুরী। বড় শখের মেয়ে আদুরী। এগুলো আদুরীর
কাপড়। খুব যতন করে ধুইতে হবে। কোন ছাড় দেওয়া যাবে না। প্রতি
সপ্তাহে একবার তিনি এই কাপড়গুলো ধৈাত করেন। পুকুরের কোল ঘেষেই
এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে দুটি তালগাছ। সেই পুকুর পাড়ে দুটি তালগাছ
এর মাঝ বরাবর একটি রশি ঝুলিয়ে দেন। পরম মমতা নিয়ে কাপড়গুলো
রৌদে শুকাতে দেন। পাশের জামগাছটার নিচে একটি মাদুর বিছিয়ে
সেখানে অপেক্ষা করেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কাপড়গুলোর
দিকে। কখন কাপড়গুলো রৌদে শুকাবে। তারপর এক অজনা আতংকে
দুঃস্বপ্নে বাতাসে শুনতে পান… “মা গো, পুড়ে যাচ্ছি”। শব্দটা শুনেই
কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পরে। কষ্টটা ভীষণ বেদনাদায়ক। তাই সহ্য না
করতে পেরে গাছটার নিচে ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য পাশের কবিরাজ,
মাওলানা, গ্রাম্য ডাক্তার অনেককে দেখানো হয়েছিল। সবাই এটাকে মিথ্যা
স্বপ্ন বলে চালিয়ে দিয়েছে। বলেছে – আগুনে পুড়লে কেহই পুড়ে যাচ্ছি
বলে না, বলে- বাঁচাও! বাঁচাও!! এই স্বপ্নটা ফাহমিদা খালা প্রায় দেখে।
উত্তপ্ত রৌদ্রে কাপড় শুকাতে বিকেল হয়। তখনও ফাহমিদা খালার ঘুম
ভাঙ্গে না। আর এভাবেই কেটে যায় ফাহমিদা খালার দিন। কখনও রোদ
কখনও বৃষ্টি। কখন বাসায় কখনও গাছের নিচে। পাশের বাড়ির তরুণ
স্বপন। সন্ধ্যে হতেই স্বপন দৌড়ে যেয়ে বলে, খালা, ও খালা সন্ধে হয়ে
গেছে, ঘুম থেকে ওঠো, বাসায় যাবে না? খালা ধপ করে ওঠে, অষ্পষ্ট বলে
“আমার আদুরির কাপড়গুলো শুকিয়েছে।”
স্বপন উত্তর দেয় “হ্যা খালা শুঁকিয়েছে”। খালা কাপড়গুলো সুন্দর করে
ভাজ করে। আদুরীর কাপড়। মেয়ে আদুরী এগুলো পরবে। তার সামনে
রাজকুমারীর মতো হেসেখেলে বাড়ি মাতিয়ে রাখবে। ফাহমিদা খালা মেয়ে
আদুরী শহরে একটি এনজিওতে চাকরি করে। সাপ্তাহে দু‘দিন সে গ্রামের
বাড়িতে মায়ের কাছে এসে থাকে। আদুরী অনেক শখ ছিল সে তার মাকে
শহরে নিয়ে যাবে। বড় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করবে। তারপর মা ও মেয়ে
মিলে সমস্ত শহর টইটই করে ঘুরে বেড়াবে।
স্বপন ফাহমিদা খালাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। সন্ধ্যের সুর্যটা
পশ্চিম আকাশে ডুবে যায়। নেমে আসে অন্ধকার। পুরনো খালটার
জ্বরাজির্নতার মাঝে জোনাকি পোকার মিটমিটে আলো। একা একা পথ
চলছে স্বপন। স্বপন গায়ের ছেলে। আদুরী আর সে একই সাথে বড়
হয়েছে এই গ্রামে। পড়াশুনা করেছে একসাথে। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ মাইল
হেটে পাশের গ্রামের স্কুলে পড়তে যেতে হয়। বিকেলে কাঁঠালচাপা,
তেতুল, আর পেয়ারা খেতে খেতে বাসায় ফেরা। ছুটির দিনগুলোতে
খালে-বিলে মাছ ধরা, মাঠের পর মাঠ দৌড়ে ছুটোছুটি করা। এলোমোলো
কাঁঠালচাপার গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া। আদুরী যেদিন থেকে
পুকুরপাড়ে গোসল করা বন্ধ করে দিয়েছে। সেদিন স্বপন বুঝতে পারলো
যে আদুরী বড় হয়েছে। তারপর একদিন একটি চাকুরী নিয়ে সে শহরে
চলে যায়। সেদিন স্বপন এর বুকটা কেমন যেনে কেঁপে উঠেছিল। মনে
হচ্ছিল তার বুকটা ছিড়ে কে যেন চলে যাচ্ছে। স্বপন সেদিন বুঝেছিল
ভালোবাসার সুখ-দুঃখ কারে কয়। সে কতটা ভলোবাসে আদুরীকে।
গতবর্ষায় একসাথে দুইজনে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিল। পুকুরপাড়ের
এককোণে বাতাবি লেবুর গাছ লাগানোর সময় আদুরী বলোেিল যেদিন এই
গাছটিতে লেবু হবে সেদিন আমি রান্না করব। তারপর একটু মিষ্টি হেসে
বলে পুটি মাছের ঝোল পাক করব। স্বপন সেদিন কিন্তু তুই আমাদের
বাসায় খাবি… বুঝলি। তখন অঝরে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে আদুরী
গায়ে জড়িয়ে থাকা কাপড়টি গায়ের রংয়ের সাথে মিশে একাকার হয়ে
গেছে। মনে হচ্ছিল একটি সুন্দর জীবন্ত মুর্তি। যার গায়ে কোন কাপড়
নেই। একটি ফুটন্ত তরতাজা পদ্ম। আদুরীর শিশুকালো পার হয়েছে।

টসটসা যৌবনের রং লেগেছে গায়ে। বৃষ্টিতে না ভিজলে হয়তো এতটা
বোঝা যেতো না। স্বপন সেদিন থেকেই মনে মনে বাসনা করে। আদুরীকে
তার বউ বানাবে। রাজকন্যাদের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে রাখবে তাকে।
ইত্যাদি নানা কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে
স্বপনের। একটি কথা সে গ্রামের কাউকে বলতে পারছে না। এমনকি
আদুরীর ‘মা’ ফাহমিদা খালাকেও না। আদুরী আর কোন দিন ফিরে
আসবে না। সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। শেষ দেখা হয়েছিল ছয়মাস
আগে। আদুরী ঢাকায় তার কর্মস্থলে যাবে। তখন প্রায় সুর্য ডুবুডুবু।
আদুরীকে বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে স্বপন। যখন গাড়ী ছেড়ে
দিবে ঠিক পূর্ব মহুুর্তে স্বপন বিদায় নিবে। তখনই বাস থেকে নেমে দৌড়ে
আসে আদুরী। লোক-চক্ষুর আড়ালে স্বপনকে একটি চুম্বন দিয়ে বলে-
“বেশ কিছু টাকা জমিয়েছি, তাছাড়া অফিস থেকে একটা স্পেশাল বোনাস
পাবো, এবার এসেই আমাদের বিয়ে। তুমি প্রস্তত থেকো। আগামী সপ্তাহে
তোমার-আমার বিয়ে। বাস ছেড়ে দেওয়ার আগেই হেলপার ডাকা শুরু
হয়ে গেলে। হেলপার জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকছে “ও আপা তারা
তারি আইয়্যেন, বাস কিন্তু এখনই ছেড়ে দিবে। বাধ্য হয়ে সেই ডাকে
পুনরায় বাসে ফিরে যায় আদুরী। স্বপন তাকিয়ে দেখে বাস ছেড়ে দিয়েছে।
জানালার পাশে বসে আদুরী হাত দিয়ে বিদায় জানাচ্ছে স্বপনকে।
ভালোবাসার মমতা ঘেরা সেই হাতের বিদায় যেনো কিছুতেই মেনে নিতে
পারছে না স্বপন। স্বপন মুগ্ধ বিস্ময়ে ভালোবাসার চরম আকুতি আর স্বপ্ন
নিয়ে তাকিয়ে থাকে আদুরীর দিকে। বাস চলে গেছে। তখনও স্বপ্নের ঘোর
কাটছে না। বিয়ের স্বপ্ন। সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেনি স্বপন। আগামী
সপ্তাহে তার বিয়ে। ঘর-দুয়ার ঠিকঠাক করতে হবে। টাকাপয়সা জোগাড়
করতে হবে। বাবা-মাকে-এ ম্যানেজ করতে হবে। আত্মীয় স্বজন সকলকে
দাওয়াত করতে হবে। নানাবিধ চিন্তাভাবনা তাকে অস্থির করে ফেলে।
নতুন বউকে ঘরে তুলতে হবে। ঘরটা সুন্দর করে সাজাতে হবে। স্বপন
এক দৌড়ে উঠোনে যায়। স্বপনদের উাঠানের মাঝখানে আজ চাঁদের
আলোর ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। উঠনের ঠিক মাঝখানে হাত দুটিকে মেলে ধরে
জ্যোৎস্না ধরার চেষ্টা করে। এক মুঠো নীল জ্যোৎস্না আমি আদুরীকে দিবো’
এই বলে চিৎকার করে আনন্দে। আর এভাবেই সেদিন সারারাত কেটে
যায়। সুন্দর একটি সকাল হয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতেই স্বপন দেখতে
পেলে, তাদের বাড়ির দক্ষিন দিকে থানার হাবিলদার এক পুলিশ একটি
ব্যাগ আর কিছু কাগজ পত্র নিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ব্যাগটি দেখে ছুটে
যায়। ব্যাগটি আদুরীর চিনে ফেলে স্বপন। তাই দৌড়ে পুলিশটির কাছে
ছুটে যায়। পুলিশ জানালো- এই ব্যাগটি আদুরীর মাকে ফিরিয়ে দিতে
এসেছি।
স্বপন তড়িঘড়ি করে বলে ‘কেন? আদুরী কোথায়?
পুলিশটা খানিকটা চোখের পানি মুছে বলল- “সে নোংরা রাজনীতির
প্রতিহিংসার স্বীকার হয়েছে, সে মারা গিয়েছে। গতরাতে ঢাকায় ফেরার
পথে দুর্বৃত্তরা পেট্টোল বোমা ছুরে মারে তার গাড়িতে। সাথে সাথে সম্পূর্ণ
গাড়িটি আগুন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ২৫ জন যাত্রী আগুনে পুড়ে মারা
যায়। এরমধ্যে আদুরী একজন। সেখানে সেও পুড়ে মারা গেছে। ব্যাগটি
গাড়ির পাশে পড়েছিল। সে জানালা দিয়ে নামার চেষ্টা করেছিল কিন্তু
পারেনি। স্বপন কথাটা শোনা মাত্রই নিজের মুখ নিজে চেপে ধরে
আত্মচিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পুলিশ হাবিলদার তাকে টেনে
তুলতেই সে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশকে প্রশ্ন করে ‘আমার আদুরীর
লাশটি কোথায় স্যার?
পুলিশ উৎকন্ঠা নিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে- ‘তার লাশটি এতটাই পুড়ে
গিয়েছে এখানে আনার মতো নয়, তাকে মেডিকেল থেকে
সোজা…কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। স্বপন পুলিশটিকে জোর অনুরোধ
জানালো এই খবরটি যেন আদুরীর মাকে না জানায়। কেননা আদুরীর
মৃত্যুর খবর শুনলে তার মা শোকে মারা যাবে। পুলিশটি ঘটঁনাটা বুঝতে
পেরে চলে যায়।
স্বপন আদুরীর ভালোবাসার কাছে সারা জীবন নিজেকে সঁপে দিয়েছে।
জীবন্ত আদুরী থেকে মৃত আদুরীকে সে বেশী ভালোবাসে। প্রায় সেই
আদুরীর কবরস্থানে ছুটে যায়। একটি গোলাপ নিয়ে তার কবরে সামনে
দাঁড়িয়ে থাকে। ভালোবাসার গভীর আকুতিতে চোখের পানি ঝরে পড়ে,
মনের অজান্তে বলে উঠে-‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আদুরী’ আমি
সারাজীবন তোমাকে ভালোবাাসবো। আর এভাবেই স্বপন প্রায় একটি
গোলাপ নিয়ে আদুরীর কবরস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে এবং একই কথা বলে
যায়। অন্যদিকে আদুরী মা প্রতি সপ্তাহে তার মেয়ের কাপড়গুলো ধুয়ে
রোদে শুকিয়ে যতœকরে রাখে। তার মেয়ে ফিরবে… পথ চেয়ে বসে থাকে
আজও সেই দুঃস্বপ্ন দেখে ফাহমিদা খালা। তার মেয়ে আদুরী ডাকছে-
মাগো-মা, আমি পুড়ে যাচ্ছি? আমাকে বাঁচাও….

জসীম উদ্দীন জয়

The Sailor
The Sailorhttps://www.thesailor.us/
“ The Sailor Magazine ” একটি অরাজনৈতিক এবং অসম্প্রদায়িক ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী ভাই বোনদের কথা বলা এবং আমরা যারা বাংলাদেশে মাতৃভূমিতে বসবাস করছি সকলের মধ্যে সমন্বয় হিসেবে আমরা আছি সবসময়, দেশ-বিদেশের খবরা-খবর সকল বিষয়ে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করাই আমাদের লক্ষ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

পল আলেকজান্দ্রার

লোহার তৈরি ফুসফুসে বেচে ছিলেন ৭০ বছর , নাম...

রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে

আজ সোমবার বাংলাদেশের আকাশে রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে...

বিল্লাল হোসেন রাজু

জীবনের প্রথম চাকরি অফিস সহকারী পদে ২০১২ সালে। তারপর...

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে রোজা হবে না।

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে...