ওপারের জগত সত্যিই কি আছে

Date:

ওপারের জগত সত্যিই কি আছে… ?

………………………………………………।

রাত্রের লেট নাইট ডিউটি টা শেষ করে ক্লান্ত পায়ে ঢুলু ঢুলু চোখে টলমল টলমল করতে করতে দরজার সামনে এসে বার কয়েক চেষ্টার পরে দরজার চাবি ছিদ্রের ভেতরে চাবি কাঠিটা শেষমেশ গুঁজে দরজাটা খুলতে সক্ষম হলো সিদ্ধার্থ!…ঠিক একাই পারলো নাকি অদৃশ্য কেউ ওকে সাহায্য করল দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে…! সিদ্ধার্থর বাড়ি ফেরার সময়ে সে কিন্তু রোজ অন্ধকারে ওই দরজাটার পাশেই এসে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারের মধ্যেই নিজেকে মিশিয়ে সিদ্ধার্থর অপেক্ষায়! বহুদূরে চলে গিয়েও এটা যেন আজও একটা কর্তব্য বলেই মনে হয় তার…!

এই আধা মফস্বল গোছের এলাকাটার একটাই সমস্যা যেটা কিনা বেশ কিছুদিন ধরেই চলে আসছে… লোডশেডিং রোজ রাত্রি ১১ টার আশেপাশে রুটিন মাফিক কারেন্ট চলে যায় আর ভোরের আগে ছাড়া সেটা আসারও কোনো ঠিক নেই। আসলে, এদিকের পাওয়ার সাপ্লাই ট্রিপ করিয়ে অন্য দিকে সুইচ করে দেয়া হয় শহরের দুটো বড়ো মিলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য, তাই আজও তার কোনো অন্যথা নেই।
সিদ্ধার্থ দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এরই মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছে…এরপর বাথরুমে চলে যাবে হাতমুখ ধুতে, কোনোদিন আবার স্নানটাও করে ফেলে…তারপর ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে সকালের বানিয়ে যাওয়া খাবার গুলো ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করে নিয়ে একাই খেতে বসে পড়বে…ওর এই রুটিন মাফিক কাজগুলো কিন্তু সৃজার মুখস্থ, জানে ঠিক কোনটার পরে কোন কাজটা সিদ্ধার্থ করবে…কিন্তু, একা একা খেতে বসলেও ওর ঠিক মুখোমুখি উল্টোদিকের আরেকটা প্লেটেও ওই খাবারের কিছুটা ভাগ খুব যত্ন করে সাজিয়ে দেবে তারই জন্য…শুধু ছোট্ট ভুলুটা কিছুক্ষন মুখ তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে সিদ্ধার্থর দিকে তাকিয়ে মাটিতে মুখ রেখে চুপচাপ পায়ের কাছে আবার শুয়ে পড়বে…!

… মোমবাতির মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে ওঠা শিখার আলোয় খেতে খেতে কিছুক্ষন পরেই সিদ্ধার্থ রেগে গিয়ে ওকে বকাবকি শুরু করে দেবে ” কিরে সৃজা… আজও তুই খেলিনা আমার সঙ্গে…একসাথে বসে যদি নাই…ই খেতে পারিস তবে কেন তুই রোজ আসিস অজানা জগতের ওই পার থেকে…কি পাস বলতো শুধু এই চোখের দেখা টুকু দেখে! আমি কিন্তু এখনো তোকে সবসময় খুব অনুভব করতে পারি… আর তোকে জন্মদিনের উপহার দেয়া সেই হারটাও আমি একই রকম ভাবে তোর গলায় পরিয়ে রেখেছি, দেখেছিস! কতদিন হয়ে গেলো বলতো…? তোর ওই ছবিটাই তো এখন আমার কাছে একমাত্র সম্বল, তোকে যে এখন শুধুমাত্র ওই ছবিতেই আমি দেখতে পাই, তাই ওতেই হারটা পরিয়ে রেখে দিয়েছি !”
” ধুরর…আমার মাথাটাই যেন মনে হচ্ছে খারাপ হয়ে গেছে…ওটা তো তোর আর আমার একটা সেলফি…সেই যে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে বরফের ওপরে তোলা মধুচন্দ্রিমার সময়, তোকে একহাতে জড়িয়ে ধরে…! কি লজ্জাটাই না পেয়েছিলিস তখন তুই, আমি যেন হঠাৎই তোর কাছে পর হয়ে গেছিলাম, সেই ছোট থেকে ডেকে আসা সিদ্ তোর কাছে হঠাৎ করেই কেমন যেন মিষ্টার সিদ্ধার্থ হয়ে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি, মুখ তুলে তাকাতেই চাইছিলিস না…! বুঝলি, আজ মনে হচ্ছে খুব জোর নেশা হয়ে গেছে রে… যাদব জী ও না সত্যিই! রোজই বলে কিনা সিদ্ সাহাব, থোড়া সা তো পি কর যাইয়ে আজ, ফির কাল সে মত পিজিয়ে বাস, কোই বাত নেহি…কিন্তু ওর ওই কাল যে কবে আসবে দুজনার কেউই তা জানিনা..!”
” এই…ই, সৃজা শোন না…তুই আর আসিস না রে রোজ নিয়ম করে এখানে আমাকে দেখতে…আমি বুঝি এতে তোরও কষ্ট হয় আর আমার তো আরোও বেশি কষ্ট হয় যখন তুই চলে যাস আমাকে একা রেখে দিয়ে…আরে, তুই এবার তো একটু বোঝার চেষ্টা কর…! নাহলে, আমাকেই তোর সঙ্গে তোর জগতে নিয়ে চল! আচ্ছা, দেখ আমি তো ভালোই…ই আছি, সত্যিই… ই ভালো আছিরে, তুই এবার চলে যা…ফিরে যা তোর নিজের জগতে… চলে যা…তুই আর আসিস না কোনোদিনই…”
…সিদ্ধার্থ গভীর ভাবে অনুভব করলো, কেউ যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওপাশের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে আস্তে আস্তে ওর পাশ দিয়েই হেঁটে বেরিয়ে চলে গেলো…ঠিক একদম সেই অতি ঠান্ডা ঘরটার মতই একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ওকে ছুঁয়ে দিয়ে ঘরটা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে গেলো অজানা কোনো এক জগতের উদ্দেশ্যে…! জুঁই ফুলের সেই হাল্কা গন্ধটা বাতাসে ভাসতে লাগলো ওর চলে যাবার পরেও হয়ে অমলিন! সৃজার তো বড়ই প্রিয় ছিল এই পারফিউমের গন্ধটা!
বেশ কয়েকটা দিন মাঝখানে পার হয়ে গেছে…আজকেও সিদ্ধার্থ আর সৃজা মুখোমুখি টেবিলে বসে হাসি ঠাট্টা খুনসুটি করছে ওই ঘরটাতেই…আজ কিন্তু ভুলু ওখানে নেই, কেউ হয়তো ওকে নিয়ে গিয়ে নিজের কাছে রেখেছে…! মালিক আর মালকিন দুজনেই না থাকলে ভুলুর দেখভালই বা কে করবে… পর্দার ওপারের জগতের সঙ্গে তো আমাদের আর সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই…!

পাড়ার লোকে এখন ওদের বাড়িটার নাম দিয়েছে ” ভুতের বাড়ি “! হয়তো কেউ রটিয়ে দিয়েছে! ওদের তালা বন্ধ বাড়িটার ভেতর থেকে নাকি প্রায়ই রাত্রে নূপুরের রিনঝিন আওয়াজ শোনা যায়…বাড়িটার আশেপাশের ভারী বাতাসে গভীর রাত্রে নাকি ফিসফিস করে কারো কথার আওয়াজ শোনা যায়! বাড়ির আশেপাশের বাতাসে গভীর রাত্রে জুঁই ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়ায়! লেট নাইট ডিউটি শেষ করে এখন আর কেউই ওই বাড়ির পাশ দিয়ে ফেরে না।
এটা আবার সেই লোকগুলোরই কোনো চাল নয়তো? যাতে আর কিছুদিন পরেই দাবী হীন জমি, বাড়ি সমেত পুরো জায়গাটাই ওদেরই দখলে চলে আসে বিনা খরচেই…?
“ডক্টার সাহাব… ডক্টার সাহাব… আপ জলদি সে ইধার আইয়ে…
…দেখিয়ে…ইয়ে দেখিয়ে সিদ্ধার্থ বাবু মুর্দাঘর ওয়ালা ফ্রিজার ট্রে পর ভাবীজী কি লাশকো হামলোগ যাহা পর রাখ্খে থে ওহি পর ক্যাইসে লেটে হুয়ে হ্যায়…! আজীব বাত…!
…পর সাহাব, আপ মুঝে ইতনা তো সামঝাইয়ে…ও, অন্দর আয়ে তো আয়ে ক্যায়সে? যব কি চাবি মেরে পাস হি থা…! ”
ডাক্তার সুনীল কুমার, যাদব জীর ডাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ফ্রিজার ট্রেতে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটার পালস্ চেক করে, দুটো চোখ টেনে টেনে দেখে, বুকে স্টেথো লাগিয়ে পরীক্ষা করে বললেন ” যাদব জী, কৃপায়া ইনহে পঞ্চনামা কে লিয়ে কিউ-রেজিষ্টার মে জলদি সে লগ্ কর দিজিয়ে… অউর শুনিয়ে, আজ রাত সে আপ ভি না থোড়া সা কম পিয়া কিজিয়ে…দরওয়াজে কি চাবি আপকে পাশ নেহি, হালাকি দরওয়াজে কি বাহার হি গিরা হুয়া থা…!
…যাদব জী বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে ডাক্তার সুনীল কুমারের চলে যাওয়ার পরে ফাঁকা প্যাসেজটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই অস্ফুটে বলে উঠলো ” ইয়ে ক্যাইসে হো সাকতা হ্যায়..!”
সিদ্ধার্থ আর সৃজা এখন কিন্তু একসাথে খুব আনন্দেই আছে, কারণ বর্তমানে ওদের একান্ত নিজস্ব জগতে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক আর ছদ্মবেশী কোন বন্ধু অন্তত নেই…আর আসবেও না হয়ত কোনোদিন…ওরা এখন একদম নিশ্চিন্ত…..

আচ্ছা, সত্যিই কি এরকম কোনো অদৃশ্য জগৎ আছে যেটা আমরা কেউই খালি চোখে কখনোই দেখতে পাইনা! হয়তো অবচেতন অবস্থায় বা মনের ভুলে সেটার অনুভব করতে পারি মাত্র! ওই জগতের বাসিন্দারা কি সত্যিই তাদের প্রিয় মানুষটার কাছে ভালোবাসার টানে বার বার ফিরে আসে বা আসতে চায় হাজার কষ্ট আর বাধা অতিক্রম করে! নাকি তারা শুধুমাত্রই ফিরে আসে তাদের প্রিয় মানুষটাকে তাদের কাছেই বরাবরের জন্য নিয়ে চলে যাবার জন্য! তারা কি ওই জগতে থেকেও আমাদের কথা ভাবেন নাকি আমরাই চাই জোর করে তাদেরকে ভুলে থাকতে! এর শতভাগ নিশ্চিত উত্তর হয়তো কারোরই জানা নেই, আমারও জানা নেই! সবটাই ঠিক যেন একটা ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পর্দা, যেটা পার করে সত্যিটা জেনে আবার ফিরে আসাটা একরকম অসম্ভব মহাজাগতিক কোনো একটা ব্যাপার! আমরা যেটা জানি সেটা হলো হাতে গোনা কিছু মানুষের ‘ নিয়ার ডেথ্ এক্সপেরিয়েন্স ‘ সম্মন্ধে, কিন্তু সত্যি অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফিরে এসে তার বর্ণনা কেউ দিতে পারেননি এখনও, হয়তো পারবেনও না কোনোদিন। পর্দার ওদিকটা বরাবরই রহস্যের পর্দার আড়ালেই থাকবে। কিছু জিনিস আড়ালে থাকাই হয়তো ভালো, হয়তো এটাই প্রকৃতির অলিখিত একটা নিয়ম। সব কিছু সব সময় সবার কাছে উন্মুক্ত থাকলে সেটা হয়ত আমাদের কাছে আনন্দের কারণ নাও হতে পারে। তারা তাদের জগতে শান্তিতে থাকুক আর তাদের উত্তরসুরি দের মন থেকে ভালো থাকার জন্য আশীর্বাদ করুক। মহালয়ার পূণ্য তিথিতে দেবীপক্ষের সূচনায় তারা এসে তাদের উত্তরসুরি দের হাতে তর্পণ করা জল গ্রহণ করে সন্তুষ্ট চিত্তে আবার ফিরে যাক অনন্ত শান্তির ধামে আর তার বদলে আশীর্বাদ স্বরূপ দিয়ে যাক আমাদের ভালো থাকার অসীম শুভ কামনা। এটারই যে আমাদের খুব প্রয়োজন সবসময়।

…… নীলিমা  সেন (নীলা) রায়পুর, ছত্তিশগড়, ভারত ।

নীলা: The James of Saturn.✍️

The Sailor
The Sailorhttps://www.thesailor.us/
“ The Sailor Magazine ” একটি অরাজনৈতিক এবং অসম্প্রদায়িক ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী ভাই বোনদের কথা বলা এবং আমরা যারা বাংলাদেশে মাতৃভূমিতে বসবাস করছি সকলের মধ্যে সমন্বয় হিসেবে আমরা আছি সবসময়, দেশ-বিদেশের খবরা-খবর সকল বিষয়ে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করাই আমাদের লক্ষ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

পল আলেকজান্দ্রার

লোহার তৈরি ফুসফুসে বেচে ছিলেন ৭০ বছর , নাম...

রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে

আজ সোমবার বাংলাদেশের আকাশে রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে...

বিল্লাল হোসেন রাজু

জীবনের প্রথম চাকরি অফিস সহকারী পদে ২০১২ সালে। তারপর...

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে রোজা হবে না।

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে...