মনের জানালা

Date:

“”” মনের জানালা “””

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জীবনকালকে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়। সমস্ত জীবনে সুখদুঃখ নানান চড়াই উৎরাই‌য়ের   মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করলেও মানুষের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো শেষের অধ্যায় বা শেষ জীবন । এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি মধ্য দিয়েই একজন মানুষ বিদায় নেয় এই সুন্দর পৃথিবী থেকে। প্রতিটা মানুষের একমাত্র চাওয়া থাকে শেষ জীবনটা সুন্দর ভাবে কাটানো তবে সবার সব চাওয়া পূর্ণ হয়না। অনেকের শেষ জীবনটা খুব কষ্টের হয় । অনেকে হয়তো ভাবতে পারে শেষ জীবনে কষ্ট বলতে নানান অসুখবিসুখ রোগশোকে ভোগাকে বলে কিন্তু একজন মানুষের শেষ জীবনের সবচাইতে বেশি সবচেয়ে ভয়ংকর কষ্ট হলো একাকীত্ব নিঃসঙ্গতা।

শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, চারিদিকেই একাকিত্ব ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। প্রবীণ-নবীন সবাই খুব দ্রুত একা হয়ে পড়ছে। এটাকেও একধরনের মহামারি বলছেন গবেষকরা। ১৯৮৫ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একাকী মানুষের সংখ্যা তিনগুণ হয়েছে, যাদের একজনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুও নাই। প্যারিসে ৫০ শতাংশ এবং স্টকহোমের ৬০ শতাংশ মানুষ একা থাকেন। যুক্তরাজ্যে ৭৫-এর বেশি বয়সি মানুষদের অর্ধেকই একা থাকেন। মাসের পর মাস ধরে তারা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা না বলে কাটিয়ে দেন।

একষট্টি বছর বয়সী একজন নারী তার ফ্ল্যাটের ড্রইং রুমের সোফায় এলিয়ে আছেন। পুলিশ আসার পর জানা গেল তিনি প্রায় দুই বছর আগে এখানে বসেই মারা গেছেন। এই ৭৩০ দিনে কেউ তাকে মিস করেনি বা তার খোঁজ করেনি, কেউ এসে বাসার কলিংবেল বাজায়নি। এমনকী এত ভয়াবহ দুঃখজনক ঘটনার পর যখন তার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তখনও সেখানে কোনো স্বজন ছিল না। ছিল না কোনো ভালবাসার স্পর্শ।

হয়তো একটা সময় তার জীবনে সব ছিল। ছিল বন্ধু, সহকর্মী, ভাইবোন। কিন্তু অবস্থা এতটাই নির্মম হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে দুই বছর কেউ তার দরজায় কড়া নড়েনি।

এই ঘটনাটি লন্ডনে বা অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্রে নতুন নয়। আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও একাকী করে তুলেছে। (দ্য গার্ডিয়ান)

ঠিক এইরকম ঘটনার মতো না হলেও এখন অনেকেই আমাদের সমাজে একাকী জীবন কাটাচ্ছেন।

আমরা এখনো গ্রাম-শহর-বিদেশ মিলিয়ে একটা ট্র্যানজিশনাল অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।

ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি ফ্ল্যাটের সাত তলায় পুলিশ দরজা ভেঙে ইকবাল উদ্দিন নামে এক চিকিৎসকের গলিত লাশ তার নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করে। তার দুই ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী দেশের বাইরে থাকেন। তিনি অসুস্থ অবস্থায় একাই ওই বাসায় থাকতেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে ফোনেই যোগাযোগ হতো। পুলিশ ৯৯৯-এ কল পেয়ে তার লাশ উদ্ধার করে। উদ্ধারের কয়েকদিন আগে মারা গেলেও কেউ জানত না। তার লাশ পচে গন্ধ বের হচ্ছিল।

উত্তরার বাসা থেকে পুলিশ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। এই খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একলা তার ফ্ল্যাটে থাকতেন।

আবু মোহসিন খান তার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনিও নিঃসঙ্গ ছিলেন।

ঢাকা শহরেও গত কয়েক বছরে নিঃসঙ্গতার কারণে আত্মহত্যা বা একাকী বাসায় মারা যাওয়ার পর লাশ কয়েকদিন পর উদ্ধারের আরো কিছু ঘটনা আছে।

এখানে আমরা বা আমাদের সন্তানরা সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। মা অথবা বাবা একা ফ্ল্যাটে থাকছেন। সন্তানরা ঢাকায় বা বিদেশে থাকেন। মায়ের বা বাবার জন্য সব ধরনের সুবন্দোবস্ত করা আছে, কিন্তু জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সন্তানরা মা-বাবার পাশে থাকতে পারছেন না। এরপর একদিন তাদের মৃত্যুর বা নিহত হওয়ার খবর পেয়ে গৃহে ফিরে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। বাবা-মা শেষ কথাটিও সন্তানের সাথে বলে যেতে পারেন না। এটাই বাস্তবতা।

আমরা খবরে দেখেছি পরপর কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, যেখানে একাকী বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে পেয়ে গৃহকর্মী বা অন্যান্য দুর্বৃত্তরা হত্যা করে রেখে গেছে। সন্তানের জন্যও এটা খুব কষ্টকর সংবাদ।

এছাড়া বয়স্ক কেন্দ্র নিয়ে যতগুলো ফিচার বা নিউজ পড়েছি, সবগুলোতে এত কষ্টকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা পেয়েছি যে মনটা ভেঙে যায়। কারো কারো সন্তান থেকেও নেই, কারো সন্তান এখানে রেখে গিয়েছে এবং মাসে মাসে টাকা পাঠায় কিন্তু দেখতে আসে না, কোনো কোনো মা-বাবাকে পরিবারে উৎপাত ভেবে সেন্টারে এনে রেখেছে। এমনকী এমনও আছে সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়ে মা-বাবাকে এখানে নিক্ষেপ করেছে।

এই আধুনিক জীবিকানির্ভর জীবন, শহুরে ব্যবস্থা আমাদের কি বিছিন্ন করে ফেলছে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের কাছ থেকে? আমরা যারা ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত, তারা কি খোঁজ রাখি পাশের বাসার মানুষটি কে বা কারা থাকেন সেখানে? তাদের ভালোমন্দ নিয়ে কি আমাদের কোনো মাথাব্যথা আছে? লন্ডনের শেলা সেলিওয়েনের মতো জীবন কিন্তু যেকোনো সময়ে আমাদেরও হতে পারে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যৌথ পরিবারে এই সমস্যা অনেক কম। বাস্তবতার কারণেই যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। কোনোটা ভালো—যৌথ না একক পরিবার, সেটা নিয়ে নানা মত আছে। কিন্তু আমার কথা হলো আদর্শ পরিবার ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে। এটাই সমস্যা।

তিনি বলেন, বয়স্করা এখন আর আড্ডা দিতে পারেন না, আগে যে পাড়ার ক্লাব বা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতেন তা এখন আর নেই। তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশে নগর জীবনে একাকিত্ব বাড়ছে। আর এই একাকিত্ব শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের মধ্যেই বেশি।

শহরের ইট-কাঠ, যন্ত্র, জীবন ব্যবস্থা, সুবিধাদি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। এখানে নিজের স্বার্থ ও প্রয়োজন ছাড়া অন্যের সাথে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে যাচ্ছে সবাই।

যার পরিণতি হয়তো একদিন হবে ভালোবাসাহীন, ঠিকানাহীন জীবন।

The Sailor
The Sailorhttps://www.thesailor.us/
“ The Sailor Magazine ” একটি অরাজনৈতিক এবং অসম্প্রদায়িক ম্যাগাজিন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশী ভাই বোনদের কথা বলা এবং আমরা যারা বাংলাদেশে মাতৃভূমিতে বসবাস করছি সকলের মধ্যে সমন্বয় হিসেবে আমরা আছি সবসময়, দেশ-বিদেশের খবরা-খবর সকল বিষয়ে পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করাই আমাদের লক্ষ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

পল আলেকজান্দ্রার

লোহার তৈরি ফুসফুসে বেচে ছিলেন ৭০ বছর , নাম...

রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে

আজ সোমবার বাংলাদেশের আকাশে রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে...

বিল্লাল হোসেন রাজু

জীবনের প্রথম চাকরি অফিস সহকারী পদে ২০১২ সালে। তারপর...

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে রোজা হবে না।

ছোটবেলায় ভাবতাম রোজা রেখে ইফতারে রুহ্ আফজা না খেলে...